কথার জালে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারদর্শী যারা - তন্ময় আহমেদ

কথার জালে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারদর্শী যারা - তন্ময় আহমেদ

পদ্মাসেতু ইস্যুতে দেশের স্বঘোষিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের ভারী বক্তব্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল সারা দেশে। দুর্নীতিবিরোধী পর্যবেক্ষকের ছদ্মবেশে দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তাদের নামে ঘুষ নেওয়ার গুজব ছড়াতে সাহায্য করে তারা। এটা ২০১১ সালের ঘটনা। বিশ্বব্যাংক যখন দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পদ্মাসেতু প্রকল্পে অর্থায়ন না করার ঘোষণা দেয়, ঠিক তার পরেই দেশজুড়ে সরকারবিরোধী বিভিন্ন অবমাননাকর মন্তব্য করতে শুরু করে একটি বিশেষ শ্রেণির প্রতিনিধিরা। আর তাদের এসব তথ্যহীন বক্তব্যের কারণে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল দেশের সাধারণ জনগণ। অথচ পদ্মাসেতু প্রকল্পে তখনো কোনো অর্থই ছাড় হয়নি, সেখানে দুর্নীতি হওয়ায় যে কোনো সুযোগই নেই, এই সর্বৈব সত্যকে তারা কৌশলে গোপনে করেছে জনগণের থেকে। যাই হোক, পরবর্তীতে কানাডার আদালতে সব অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। দেরিতে হলেও জনগণের সামনে স্পষ্ট হয়ে পড়ে সবকিছু।

কানাডার আদালতের ওই রায়ে পরিষ্কার করে বলা হয়, পদ্মাসেতু প্রকল্পের বিষয়ে অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং গুজবের ওপর নির্ভর করে এসব অভিযোগ করা হয়েছে, এর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। তথাকথিত কিছু সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি, দুর্নীতিবিরোধী কয়েকটি সংস্থার কর্তাব্যক্তি এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর কর্মকর্তারা তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের নামে অপবাদ ছড়িয়েছেন। এমনকি প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকেও। এটি নিঃসন্দেহে একটি বাজে ঘটনা।

মূলত, এই ঘটনায় যুক্ত পরিচিত নাগরিকরা যারা নিজেদের সুশীল সমাজের অভিজাত প্রতিনিধি হিসেবে দাবি করেন, তারা কোনো সঠিক তথ্য ছাড়াই সম্পূর্ণ গুজবের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে প্রধানমন্ত্রী এবং দেশকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছেন। এমনকি দেশের সাধারণ মানুষের সামনেও প্রধানমন্ত্রীকে হেয় করার অব্যাহত অপচেষ্টা চালিয়েছেন। সরকারকে নিয়ে তাদের অবস্থান সবসময়ই এরকম, তাদের এই আচরণ নিন্দনীয়।

ঠিক একইভাবে করোনাকাল নিয়েও বহুমাত্রিক কথা ছড়িয়ে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছিল একটি মহল। সম্প্রতি ড. মুহাম্মদ ইউনুস দাবি করেছেন- সব মানুষকে টিকা দিতে ৫৭ বছর লাগবে। ততদিনে বিশ্বের সব মানুষ মরে সাফ হয়ে যাবে। এজন্য তিনি এখন টিকা উৎপাদন করতে চান। এসব বক্তব্যের মাধ্যমে মানুষকে বাঁচাতে সরকারের দেড় বছরের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টাকে একরকম অস্বীকার করার চেষ্টা করছেন তিনি। বাংলাদেশের সরলপ্রাণ মানুষের মধ্যে কথা ছড়িয়ে একটা অস্থিরতা ও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা হয় এভাবেই। এনারা বলেন অর্ধেক কথা এবং করার সময় কিছুই করেন না। পশ্চিমা বিশ্বের কাছের মানুষ ড. ইউনুস গত দেড় বছরের করোনাকালে গণমানুষের জন্য কোনো ভূমিকাই পালন করেননি। তাকে বা তার প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেখা যায়নি কোথাও। দীর্ঘ চেষ্টার মাধ্যমে সরকার বিভিন্নভাবে ভ্যাকসিন সংগ্রহ করা নিশ্চিত করেছে, প্রান্তিক মানুষের জন্য ঘরে ঘরে খাদ্য পৌঁছাচ্ছে, অতিরিক্ত চিকিৎসক নিয়োগ দিয়ে গণমানুষের চিকিৎসা নিশ্চিতের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে, গরিবদের নগদ অর্থ দিচ্ছে, এমনকি প্রবাসফেরত কর্মজীবীদেরও ভাতা দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এরকম একটি পরিস্থিতিতে এসে বড় বড় মানবিক কথা বলে মানুষের মনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে কারা! তার নজির আমরা পদ্মাসেতু ইস্যুতেও দেখেছি।

পদ্মাসেতু প্রকল্প নিয়ে গুজবের বিষয়ে বিএনপির ভূমিকা ছিল আরো ন্যাক্কারজনক। পদ্মাসেতুতে দুর্নীতির কল্পিত অভিযোগকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের অজুহাতে বিএনপির শীর্ষ নেতারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইমেজ নষ্ট করার পাঁয়তারা করছিল। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল, প্রধানমন্ত্রীর ওপর দোষ চাপানো। এমনকি তাদের অব্যাহত অপপ্রচারের কারণে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন দুর্নীতির দায় অস্বীকার করে এবং সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে পদত্যাগ পর্যণ্ত করেছেন। কিন্তু এই ঘটনার ওপরও রঙচঙ মাখায় বিএনপি ও তথাকথিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। এই ইস্যুটিকে তারা কীভাবে দেখেছেন, আসুন একনজরে তা দেখে আসি।

এই কল্পিত অভিযোগের পক্ষে বিন্দুমাত্র তথ্য না পাওয়া গেলেও, একে বাস্তব বলে ধরে নিয়ে বক্তব্য দেন সুশীল সমাজের প্লাটফর্ম সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক)- এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। সেসময় তিনি গণমাধ্যমে বলেছেন, 'দুর্নীতি যে আমাদের জাতীয় উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে এটি তার আরো একটি উদাহরণ। বিদেশি দাতাদের অর্থায়নের ওপরও এই ঘটনা প্রভাব ফেলবে। কারণ দাতারা বাংলাদেশের দুর্নীতির বিষয়ে এখন আরো সতর্ক হবে।'

এই কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেছেন. 'এই ঘটনায় দেশের ইমেজ নষ্ট হয়েছে এবং ভবিষ্যতে বিদেশি সহায়তা পেতে সমস্যা হবে।'

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরেকজন সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলী খান বলেছিলেন, 'বিশ্বব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত পরোক্ষভাবে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য বিদেশি সহায়তার ক্ষেত্রে ক্ষতির কারণ হবে। কোনো দাতা সংস্থা নতুন কোনো প্রকল্পে অর্থায়নের আগে দুর্নীতির বিষয়ে সন্দেহ করবে।'

টিআইবি এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, 'এটা (যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগ) সম্ভবত দেরি হয়ে গেছে। কয়েকমাস আগে বিশ্বব্যাংক অভিযোগ তোলার সঙ্গে সঙ্গেই তার পদত্যাগ করা উচিত ছিল।'

আরো দুঃখজনক ব্যাপার হলো, সরকার যখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণের ঘোষণা দিলো, তখনও সেটা নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়েছে টিআইবি। এক বিবৃতিতে তারা জানায়, সরকারের এই উদ্যোগ মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর একটি প্রচেষ্টা মাত্র। তবে এই উদ্যোগ সফল হলেও তাতে সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরে আসবে না।

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনকে দেশপ্রেমিক বলে করা প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যকে তীর্যকভাবে আক্রমণ করে তিনি বলেন, 'সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর সাহস থাকলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পরপরই পদত্যাগ করা উচিত ছিল।'

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছিলেন, 'মন্ত্রীর পদত্যাগ প্রমাণ করে যে, বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ অনুসারের পদ্মাসেতুর অর্থায়নে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। যদিও ইতোমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তবে এই পদত্যাগ সরকারের অ্যাকশনের কথাই প্রমাণ করছে।'

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দীর্ঘ ২৭ বছর ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড (আইএমএফ)-এ কর্মরত ছিলেন। তিনি এই ঘটনাকে অনাকাঙ্ক্ষিত বলে অভিহিত করে বলেছিলেন, 'প্রশাসনিক সংকটের কারণে দেশের বৃহত্তম প্রকল্পটি নিশ্চিত হয়ে পড়েছে।'

এসব তো গেলো সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের একাংশের কথা। সেসময় বিএনপি নেতারা ছিল আরো এককাঠি সরেস। রীতিমতো আনন্দ-উৎসব শুরু করেছিল তারা। তাদের বক্তব্যগুলো ছিল খুবই আপত্তিকর। এমনকি পদ্মাসেতুকেন্দ্রিক গুজব ও অপপ্রচারকে জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে আনুষ্ঠানিক সেমিনার আয়োজন করতো বিএনপি নেতারা। এসব সেমিনারের টাইটেল দিতো তারা 'পদ্মাসেতুর দুর্নীতি' শিরোনামে। ২০১২ সালের ১০ জুলাই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সেমিনার করেন। তাদের সেই সভার নাম ছিল: 'পদ্মাসেতু নির্মাণে দুর্নীতি, বিশ্বব্যাংক কর্তৃক অথায়ন বাতিল, অর্থনৈতিক সংকটে বাংলাদেশ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন'। সেখানে মির্জা ফখরুল বলেন, 'বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতু নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগে তিন জনের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ এনেছে। তারা হলেন- প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন।'

মির্জা ফখরুল আরো দাবি করেন, 'আবুল হোসেনের পদত্যাগ প্রমাণ করে যে, পদ্মা সেতুর প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে। তিনি যদি অভিযোগ ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই পদত্যাগ করতেন, তাহলে ঋণ বিষয়ক চুক্তিতে কোনো সমস্যা হতো না।'

এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বলেন, 'আবুল হোসেন যদি দেশপ্রেমিক হয়, তাহলে দেশপ্রেমিক নয় কে? তার প্রতি প্রধানমন্ত্রীর এই সমর্থন মানুষকে ভালো বার্তা দেয় না। এর মাধ্যমে জনগণের অর্থ লুটপাটকারীদের রাজনীতি করার বৈধতা দেওয়া হচ্ছে।'

এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নিজে তো বিভিন্ন সমাবেশ প্রকাশ্যেই বলেছেন, পদ্মাসেতু হবে না। আওয়ামী লীগ সরকার এই সেতু বানাতে পারবে না। এসব ভিডিও ফুটেজ এখনও ফেসবুক-ইউটিউবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যাই হোক, সেসময় তিনি নিজের গুলশানের অফিসে এক রাজনৈতিক কর্মশালা শেষে বলেন, 'স্বাধীনতার পর এই প্রথম দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক কোনো উন্নয়ন প্রকল্প থেকে অর্থায়ন বাতিল করলো।'

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনকে। তিনি বলেন, ' আবুল হোসেনের দেশপ্রেম নেই। বিশ্বব্যাংক তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার ১০ মাস পর তিনি পদত্যাগ করলেন, তার লজ্জা নেই।'

এই সুযোগে প্রধানমন্ত্রীকেও ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করতে পিছপা হননি বিএনপি নেতারা। দলটির আরেকজন শীর্ষ নেতা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসম হান্নান বলেছিলেন, 'শেখ হাসিনা একজন দুর্নীতিগ্রস্ত প্রধানমন্ত্রী। তার উচিত পদত্যাগ করা।'

অথচ বাস্তবতা হলো, এসবই ছিল মিথ্যা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এমনকি এসব