কী নামে ডেকে বলবো তোমাকে, মন্দ করেছে আমাকে ঐ দুটি চোখে ঃ বিশ্ব শিক্ষক দিবসের ভাবনা

কী নামে ডেকে বলবো তোমাকে, মন্দ করেছে আমাকে ঐ দুটি চোখে  ঃ বিশ্ব শিক্ষক দিবসের ভাবনা

মতামতঃ সাঈদ আনাম, 
গতকাল ছিলো বিশ্ব শিক্ষক দিবস। পৃথিবীর প্রায় একশত দেশে দিবসটি পালোন হলো। কিন্তু দুঃখের  বিষয়, বাংলা দেশে এটি নামেমাত্র একটি দিন হিসেবেই এসেছে। এখানে জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে পালোন তো হয়ইনি, বরং সাধারণ ভাবে  উজ্জাপনো হলো না।  অথচ এ দেশে কতো রকমের দিবস যে পালোন ও উজ্জাপন হয় তার ইয়াত্তা নেই ! 

তার মানে দাঁড়ালো, এদেশে শিক্ষক খুব একটা প্রয়োজনীয় ব্যক্তি বা বিষয় না ! তার চেয়ে বরং বিভিন্ন রোগবালাই দিবস, ভালোবাসা দিবস, বাঘ দিবস, পানি দিবস - এ গুলো আমাদের জনগন, প্রশাসন ও সরকারের কাছে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। তা না হলে বহু দিবস উপলক্ষে আমরা রাষ্ট্র প্রধান ও সরকার প্রধানের বাণী দেখি। পত্রিকায় বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হতে দেখি। ঢোল-ঢক্কর বাজিয়ে পথে পথে শোভাযাত্রা দেখি। সভা - সেমিনার - সিম্পোজিয়াম  দেখি। কিন্তু শিক্ষক দিবসে তো এমন কিছুই হলো না। রাষ্ট্রিয় ভাবে তো নয়ই ; এমন কি প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক দিবসটি উপলক্ষে নেই কোনো আয়োজন। 

অথচ আমরা দেশ গঠন করতে চাই, ভালো শিক্ষা চাই, ভালো রেজাল্ট চাই, ভালো মানুষ চাই। এতো গুলো চাওয়া পুরেনর একমাত্র আকোর হলো শিক্ষক - এটা আমরা বুঝলেও মানতে চাই না। সুতরাং  ভালো শিক্ষক আমরা বানাতে চাই না। ভালো শিক্ষক তৈরীতে কোনোরকম প্রনদোনাও দিতে চাই না। 

খুবই পরিতাপের বিষয় বাংলাদেশে শিক্ষকতা আলাদা কোনো পেশা না। সরকারের অন্য পাঁচটা কর্মচারীর মতো শিক্ষকও প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী মাত্র। অন্যসব সার্ভিস রুল দিয়েই শিক্ষকদের পরিমাপ করা হয়। বেতন কাঠামো তো নাইই।   অথচ শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র একটি চাকুরী কাঠামো থাকা যে কতোটা জরুরি ও প্রয়োজনীয় তা প্রতিটি উন্নত ও সভ্য দেশমাত্রই উপলব্ধি করতে পেরেছে। আমাদের পাশের অনেক দেশও সেটা করতে পেরেছে। কিন্তু আমরা এখানে পারিনি। 

কারন,  বাংলাদেশে সব চেয়ে সহজ ও শস্তা মাল হলো শিক্ষক। এ দেশে সব চেয়ে ফ্রিতে খাটানো যায় শিক্ষকদের। যেকোনো কাজে সবার আগে নামানো যায় শিক্ষকদের। ভোটার তালিকা থেকে শুরু করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে টয়লেট গণনা, সবই করানো হয় শিক্ষকদের দিয়ে। যে জাতি তার শিক্ষকদের দিয়ে টয়লেট গণনা করায়, সেই জাতির শিক্ষার মান যে কোন দিকে যাবে,  সেটা অনুমান করার জন্য নিশ্চই বুদ্ধিজীবি ভাড়া করতে হবে না ? 

এবার একটু বলি মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর নিয়ে। শিক্ষা ব্যবস্থার টার্নিং পয়েন্ট হলো মাধ্যমিক স্তর। অথচ মাধ্যমিকের শিক্ষা কাঠামোটাই বাংলাদেশ সবচেয়ে নড়বড়ে। মাদ্রাসা শিক্ষায় প্রশাসনিক ভাবে একটি আলাদা রুপ দেওয়া হয়েছে। কারিগরি শিক্ষার জন্যও একটা ব্যবস্থা করা হয়েছে। অথচ লক্ষ লক্ষ মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিচালনা করা হচ্ছে উচ্চশিক্ষার সাথে।   কিন্তু উচ্চশিক্ষার সাথে মাধ্যমিকের সামান্যতম যোগসূত্র নেই।

 কেনোনা মাধ্যমিকের পর উচ্চশিক্ষায় যাওয়ার আগে আরো একটি টার্নিং পয়েন্ট আছে সেটা হলো, উচ্চমাধ্যমিক। উচ্চশিক্ষার সাথে যে মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরটি নয়  বরং উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা স্তরটি সংযুক্ত - এই সাধারণ সত্যটা আমাদের শিক্ষার নীতিনির্ধারকদের বুঝতে যে আরো কতো দিন লাগবে সেটা একমাত্র আল্লাহ পাকেই জানেন ! 

অথচ শিক্ষার গুণগত মান ও শিক্ষাপ্রশাসনের কাঠামোগত উন্নয়নের জন্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের আওতার অবশ্যই মাধ্যমিক নামে আলাদা একটি শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা অতিব জরুরী এবং সময়ের অনিবার্য দাবী। উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার জন্য আলাদা একটি অধিদপ্তর থাকাও প্রয়োজন।   কেনোনা শিক্ষাস্তর, নিয়োগকাঠামো, এবং সর্বোপরি শিক্ষার লক্ষ্যের দিক থেকে মাধ্যমিকের সাথে উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই। বিষয়টি আরো স্পষ্ট হচ্ছে, বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকারের নতুন শিক্ষানীতির মধ্যদিয়ে। সেখানে মাধ্যমিকে কোনো বিভাগ বিভাজন থাকছে না। যা পৃথিবীর অনেক দেশেই  নেই। সুতরাং,  কেনো তাহলে প্রশাসনিক ভাবে মাধ্যমিকের সাথে উচ্চশিক্ষাকে রেখে একটা লেজেগোবরে অবস্থার সৃষ্টি করা ?

 এখানে উল্লেখ্য যে, উচ্চশিক্ষার পন্ডিতরা নিজেদের পন্ডিতি জাহির করার জন্য ও ক্ষমতার পরিধি বাড়াবার জন্য মাধ্যমিক স্তরকে তাদের বগলদাবা করে রাখতে চায় মাত্র। এর বাইরে শিক্ষার অতিগুরুত্বপূর্ণ স্তর তথা মাধ্যমিক স্তর বিষয়ে তাদের কোনো শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, দক্ষতা - এসবের কিছুই নেই। আর এসব নেই বলেই তাদের তত্বাবধানে যুগে যুগে মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না। উচ্চশিক্ষার সাথে মাধ্যমিককে রাখাটা  অনেকটা সৎছেলের প্রতি সৎমায়ের বিরুপ আচরণের মতো। 

মাধ্যমিকের শিক্ষকরা আজ নিজভূমে পরবাসি। ফলে, মাধ্যমিকের শিক্ষকরা উচ্চশিক্ষা থেকে আসা তাদের উপরওয়ালাদের যে নামেই ডাকুক না কেনো ; মাধ্যমিক শিক্ষকদের প্রতি ঐ উপরওয়ালাদের বাঁকা চাহুনি পুরোমাধ্যমিক শিক্ষা পরিবারটিকে মন্দ করে ফেলেছে। 

তাই শিক্ষদিবসে বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ, আগামী বছরের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের আগেই আলাদা একটি মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর গঠন করুন। আর বিশ্ব শিক্ষক দিবসটি জাতিয় ভাবে উজ্জাপনের মাধ্যমে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র পেশামর্যাদাটি প্রতিষ্ঠিত করার দুয়ার উন্মোচন করুন। 

সকল শিক্ষকের জন্য শুভকামনা।